মানবাধিকার রক্ষায় স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় বুদ্ধিজীবীত্বের অনুশীলন এবং সিভিল সমাজ

মানবাধিকার রক্ষায় স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় বুদ্ধিজীবীত্বের অনুশীলন এবং সিভিল সমাজ

মুঃ আবদুল হাকিম

একাডেমিয়া বা গণমাধ্যমের কাছে নানান অজুহাতে কোনো তথ্য প্রকাশ না করে লুকিয়ে রাখলে রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা স্বত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এখান থেকেই দুর্নীতির শুরু। সকল তথ্য এবং জ্ঞানে জনগণের নিঃশর্ত প্রবেশাধিকার না থাকলে রাষ্ট্রে জনগণের মালিকানা কায়েম হয় না। রাষ্ট্রকে জনবান্ধব করার জন্য এবং রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য শক্তিশালী এবং স্বাধীন একাডেমিয়া খুব জরুরি। আমাদের দেশে রাষ্ট্রের আমলনামার একাডেমিক স্ক্যানিং এবং রিপোর্টিং হয় না। একাডেমিক প্রিজম বা অনুবীক্ষণযন্ত্রে রাষ্ট্রকে পরীক্ষা নিরীক্ষা বা বিশ্লেষণ করা হয় না। মোদ্দা কথা রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডের একাডেমিক রিভিঊ করার কোনো সংস্কৃতি বা পরিবেশ আমাদের দেশে নেই।

একটি আমব্রেলা আইনের মাধ্যমে সকল সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত না হলে স্বাধীন এবং শক্তিশালী একাডেমিয়া গঠন করা সম্ভব নয়। যে দেশে একাডেমিয়া স্বাধীন নয় সে দেশে মিডিয়া স্বাধীন হতে পারে না। জ্ঞান ও তথ্যের মহিমাকে সবার উপরে স্থান দিতে হলে এবং দুর্নীতি, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও বিদেশে টাকা পাচার ঠেকাতে হলে সাংবিধানিক উচ্চ শিক্ষা কমিশন গঠন করতে হবে। জ্ঞান ও তথ্যকে কমিশন কারো স্বার্থে বিকৃত হতে দিবে না এবং বিজ্ঞানমনস্কতাকে তারা উৎসাহিত করবে। তাদের হাতে থাকবে সত্যিকার জ্ঞানের আলো। সেই আলো সর্বদা প্রজ্জ্বলিত রেখে তারা পথ চলবে। সমস্ত জনগণের সকল তথ্য তাদের হাতে থাকবে। জ্ঞান গবেষণাকে তারা এগিয়ে নেবে। নির্ভুল তথ্য, জ্ঞান ও গবেষণার ফলাফলের জন্য গণমাধ্যম তাদের কাছে ধর্ণা দিবে।

কোনো স্বার্থান্বেষী মহল জ্ঞান ও তথ্যের দখল নিয়ে দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারবে না। দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে তারা সবার উপরে স্থান দিবে। তারাই দেশে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সূচনা করবে এবং তা অনুশীলন করবে। জাতির বিবেক হিসেবে তারা জনগণকে সজাগ ও সচেতন করবে। তারা গ্রাজুয়েট পপুলেশন কে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে ব্যবহার করবে। তারা শিক্ষার বিশ্বমান বব্জায় রাখবে। সারা পৃথিবীর যাবতীয় জ্ঞান, তথ্য এবং গবেষণাকে তারা ধারণ করার চেষ্টা করবে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে তারা মানুষ তৈরির শ্রেষ্ঠ কারখানায় রূপান্তরিত করবে। তারা শুধু উচ্চ শিক্ষিত মানুষ তৈরি করবে না।তাদের যথাযথ কর্মসংস্থানের বন্দোবস্তও করবে।তারা মানব সম্পদ উন্নয়ন ,জনস্বার্থ, মেধা এবং শিক্ষা কমিশন হিসেবে কাজ করবে। কর্মসংস্থানও তাদের দায়িত্বের অন্তর্ভূক্ত থাকবে। যাতে একজন উচ্চ শিক্ষিত মানুষও দেশে বেকার জীবন যাপন না করে।

প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মসংস্থান বিভাগ থাকবে। তারা উচ্চশিক্ষা কমিশনের সাথে সমন্বয় করে সবার কাজের ব্যবস্থা করবে অথবা অন্তর্বতীকালীন ভাতার ব্যবস্থা করবে। প্রত্যেক গ্রাজুয়েট শিক্ষা অনুসারে এই ভাতা পাবে। কেউ বঞ্চিত হবে না। দেশে অথবা বিদেশে কর্মসংস্থান হতে পারে। আইন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কর্মসংস্থানে বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হলে তারা নিজ গরজে বাধ্য হবে সিলেবাস আধুনিক করে শিক্ষার বিশ্বমান অর্জন করতে। দেশের সকল সমস্যার সমাধানের ফর্মূলা তারা বের করবে। জ্ঞান সমাধান অন্বেষা এবং প্রয়োজনীয় আইন ও নীতি সংস্কারের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র শিক্ষক স্বাধীন, নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়ার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকবে।তা না হলে কর্মসংস্থানের গুরুদায়িত্ব তারা পালন করতে পারবে না।
মেধাতন্ত্র এবং পলিসি রেজিম, নলেজ রেজিম ও নলেজ ইকোনমি বাস্তবায়নে একাডেমিয়াকে পূর্ণ সমর্থন যোগাতে হবে সামরিক এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্র থেকে। সাংবিধানিক উচ্চ শিক্ষা কমিশনের মাধ্যমে বাছাইকৃত দেশের সেরা মেধাবী সন্তানেরা সর্বোচ্চ পদ মর্যাদা এবং বেতনে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। যাতে গণসম্পৃক্ত মুক্তবুদ্ধির চর্চায় নিজ গুণে একাডেমিয়া নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। একাডেমিয়া তাদের যোগ্যতা, সক্ষমতা ও জনস্বার্থ রক্ষায় পারদর্শিতা দিয়ে জনগণের মন জয় করবে এবং নেতৃত্বের আসন অর্জন করবে। জনগণের সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান খুঁজে বের করার মাধ্যমে। রাষ্ট্র ও সমাজের শৃংখলাই হবে তাদের প্রজ্ঞার প্রমাণক। জ্ঞান, তথ্য এবং নৈতিকতার কেন্দ্রবিন্দু হবে বিশ্ববিদ্যালয়। উদ্ভাবনের কেন্দ্রবিন্দু হবে বিশ্ববিদ্যালয়। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হবে বিশ্ববিদ্যালয়। এটা হবে বিশুদ্ধ রাজনীতির উৎসমুখ।সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার উৎস মুখ। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতারও উৎসমুখ। জ্ঞাণী গুণীদের মিলনস্থল বা মিলনমেলা। একজন চ্যান্সেলর এবং দুইজন ভাইস চ্যান্সেলর সিনেট কতৃক দুই বছরের জন্য নির্বাচিত হবে। ডীন, প্রক্টর এবং প্রভোষ্ট মনোনীত অথবা নির্বাচিত হতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে খোলামেলা বিতর্ক স্থল এবং সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং অপরাধের নিরাময় ও বিনাশকেন্দ্র। লাইভ সমাজ চর্চার কেন্দ্র। শিল্প, সাহিত্য এবং সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র।গবেষণার কেন্দ্র। বেসরকারি আমলাতন্ত্রের সূতিকাগার। ক্যাম্পাসের বাইরের বাস্তবতাকে ভিতরে এনে দেখা এবং বিশ্লেষণ করা হবে সমাজ বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পবিত্র দায়িত্ব । সেনা কর্মকর্তাগণ এখানে পড়ার কোনো সুযোগ না পেলেও তাদের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। বেসরকারি আমলাগণও ইদানীং উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছেন এবং বিদেশ থেকে পি এইচ ডি ডিগ্রী অর্জন করছেন। কাজেই উচ্চ শিক্ষিতদের সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং কর্মশালার ঘন ঘন আয়োজন হতে এখান থেকে কোনো বাধা আসবে না বলে আশা করা যায় ।

সামরিক এবং বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমর্থন পেলে ছাত্রশিক্ষকগণ তাদের নিরপেক্ষ এবং নির্দলীয় জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নির্দ্বিধায় নিয়ে যেতে পারে। সমাজ বিজ্ঞানচর্চাকে একটা নতুন মহিমা এবং মর্যাদা আরোপ করা যায়। তাছাড়া দেশে সন্ত্রাস এবং দুর্নীতির গডফাদারদের কোনো ক্রমেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা ছাড়া জ্ঞানচর্চা নিরর্থক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অভিভাবকত্বে এটা ঘটবে । শিক্ষাঙ্গনকে দলীয় রাজনীতিমুক্ত করা সম্ভব না হলে বিশ্বমান অর্জন করাও অসম্ভব। আবার বিশ্বমান অর্জিত না হলে শতভাগ কর্মসংস্থানের গুরুদায়িত্ব তারা যথাযথভাবে পালন করতে পারবে না।

জনগণ উগ্রতা বা চরমপন্থা পছন্দ করে না। ধর্মীয় বা দলীয় উন্মাদনা পছন্দ করে না। একইসাথে তারা ধর্মভীরু ও ধর্মনিরপেক্ষ থাকতে চায়। কিছু মানুষ ফ্যাসিবাদী হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ জনগণ কোনোদিন ফ্যাসিবাদী হতে পারে না। জনগণের কাছে ফ্যাসিবাদ একটি দুঃসহ বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বাধীন করা হলে এখানে প্রতিনিয়ত ছাত্রশিক্ষকদের চিন্তা চেতনা এবং আমলনামার একাডেমিক অডিট এবং বিশ্লেষণ হবে। এগুলো ভিন্নমতের একোয়ারিয়াম বা সোকেইস হিসেবে কাজ করবে। হিংসা, হানাহানি, ঘৃণাবিদ্বেষ, খুনখারাবি, আতংক, বিভীষিকা ইত্যাদির পরিবর্তে এখানে পরমতসহিষ্ণুতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, যুক্তিবাদিতা, শান্তিবাদিতা, মানবতা, উদারতা,সততা, সমতা, ন্যায্যতা, জ্ঞানপিপাসা, অনুসন্ধিৎসা ইত্যাদির চাষাবাদ এবং অনুশীলন হবে। ছাত্রশিক্ষকদের মাথায় অন্য কারো এজেন্ডা বাস্তবায়নের চিন্তা কাজ করবে না।

বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা না থাকলে স্বাধীন বুদ্ধিজীবীত্ব সৃষ্টি হয় না এবং জ্ঞান পাপের প্রবণতা বেড়ে যায়। একটি গাড়িকে প্রতিবছর সার্ভিসিং করতে হয়। পঞ্চাশ বছরের অধিক বয়স্ক রাষ্ট্রযন্ত্রকে কতদিন আর মেরামত ছাড়া চালানো যায়। আর স্বাধীন বুদ্ধিজীবীত্ব না থাকলে রাষ্ট্র সংস্কারের থিংক ট্যাংক গড়ে ওঠে না। বড় আকারে রাষ্ট্র সংস্কার করতে হলে পশ্চিমা বিশ্বের আদলে অনেক স্বাধীন থিংক ট্যাংক দরকার। বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা আসে একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের একাডেমিক স্বাধীনতা এবং স্বায়ত্তশাসন থেকে। এ ধরণের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে চ্যান্সেলর এবং ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ হয় স্বাধীন এবং স্বচ্ছ আইনী প্রক্রিয়ায় । এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মন্ডলীর পাশাপাশি ছাত্ররাও স্বাধীন। এগুলো চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার জন্মভূমি। এখান থেকে সৃষ্টি হয় জাতির বিবেক। এখান থেকে তৈরী হয় সরকারের জবাবদিহিতা, সংসদের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং আমলাতন্ত্রের জব অটোনমির দর্শন।

বুদ্ধিজীবীর কোন নির্ধারিত সংগা নেই।তবে আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস আছে যেদিন সদ্যজাত নতুন রাষ্ট্রটির বুদ্ধিজীবীত্বকে হানাদার বাহিনী হত্যা করতে চেয়েছিল যাতে বাঙালি জাতি আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। বাঙালি অন্তরের অনেক গভীরে বুদ্ধিজীবী হত্যার হৃদয়বিদারক ঘটনা থেকে উদ্ভূত বিনম্র শ্রদ্ধামিশ্রিত একটি উপলব্ধি আছে। বুদ্ধিজীবী হত্যার মধ্য দিয়ে আর কোনো রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। স্বাধীন ও নির্দলীয় বুদ্ধিজীবীত্ব একটি রাষ্ট্রের আত্মার মত। বিশ্বমাপের বুদ্ধিজীবীত্ব একটি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রতীক।এ কারণে সংজ্ঞা না থাকলেও শব্দটি আমাদের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের চেতনা। কারা সত্যিকার বুদ্ধিজীবী এ ব্যাপারে কোনো ন্যাশনাল কনসেন্সাস ভিত্তিক প্যারামিটার নেই। তবে জাতীয় দৈনিকে একুশ জন, একত্রিশ জন অথবা বায়ান্ন জন বরেণ্য বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি প্রায় আমাদের চোখে পড়ে। বিবৃতির ধরণ দেখে বুদ্ধিজীবীদের চিন্তার ধরণ সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করা হয়। বেশীর ভাগ সময়ই দেখা যায় তাঁরা কোন ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করছেন, নিন্দা প্রকাশ করছেন,দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন অথবা মুক্তি দাবি করছেন অথবা স্পেশাল ট্যাইবুনাল গঠন করে বিচার দাবি করছেন। অথচ রাষ্ট্র গঠনে তাঁদের মেধা, অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, বিচ ক্ষণতা এবং পারদর্শিতা ব্যবহারের কোনো সুচিন্তিত মাস্টারপ্ল্যান নেই। জাতি হিসেবে আমরা মতানৈক্য বিলাসী হলেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং দেশের বৃহত্তর স্বার্থে স্বাধীন বুদ্ধিজীবীত্বের ছত্রছায়ায় বিকশিত আমাদের সিভিল সমাজ ন্যাশনাল কন্সেন্সাস মেকার হতে পারে।

প্রতিষ্ঠান অরাজনৈতিক হতে পারে।ব্যক্তি কি অরাজনৈতিক হতে পারে? ব্যক্তির অরাজনীতি সম্পর্কে আমাদের ধারণা হচ্ছে ব্যক্তিটি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য নয়। যে রাজনীতি করে না তাকে নিয়ে কেউ না কেউ রাজনীতি করে। মানুষ নিয়ে রাজনীতি হয়। কাজেই মানুষ অরাজনৈতিক বা অসামাজিক কোনো জীব হতে পারে না। মানুষ কোনোদিন সমাজ বা রাজনীতির বাইরে থাকতে পারে না। তবে দলের বাইরে থাকতে পারে। মানুষ যখন বলে আমি কোনো রাজনীতি করি না তার অর্থ দাঁড়ায় সে কোনো দলের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়।অর্থাৎ অরাজনীতি এবং নির্দলীয়তা সমার্থক।

নিরপেক্ষতা তাহলে কি ? ধর্মনিরপেক্ষতা আমাদের চারটি রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অন্যতম। সেকুলারিজম দুই ধরণের হার্ড এবং সফট। বাংলা করলে দাঁড়ায় উদার এবং কট্টর ধর্ম নিরপেক্ষতা। তুরস্কে আরবীতে আজান দেয়ার অপরাধে একজন প্রধানমন্ত্রীকে মৃত্যুদন্ড আরোপ করার মাধ্যমে কট্টর ধর্ম নিরপেক্ষতার নজির স্থাপন করা হয়। এ কারণে আলেম সমাজে ধর্মনির পেক্ষতা সম্পর্কে একটি বিরূপ ও নেতিবাচক ধারণা আছে এবং সাধারণ মুসলমানদের মধ্যেও এ নিয়ে ভয় আছে। পরকালের ভয়ে সাধারণ মানুষ ধর্ম হারাতে চায়না। আমরা সফট সেকুলারিজমে বিশ্বাসী। কেউ কেউ এটাকে ধর্মহীনতার প্রাথমিক পদক্ষেপ বা লক্ষণ মনে করলেও ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মহীনতা সমার্থক নয়।ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিই ধর্মের অস্তিত্বসূচক।এ শব্দে ধর্মকে নাকচ করা হয়নি। বরং ধর্মনিরপেক্ষতা প্রকৃত অর্থে যে কোনো রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতার গ্যারাণ্টি। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা সকল ধর্মের ধর্মীয় স্বাধীনতার নামান্তর বা সমার্থক । জাতিসংঘ বা বিশ্ব একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। সংবিধানে উল্লেখ থাকুক বা না থাকুক দুএকটি বাদে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্র ধর্ম নিরপেক্ষ। অল্প কিছ বাদ দিলে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও ধর্মনিরপেক্ষ। রাষ্ট্র যেহেতু ধর্ম নিরপেক্ষ সেহেতু সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও তা অবশ্যই দল বা মত নিরপেক্ষ। অর্থাৎ সত্যিকার ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কোনো ধর্ম, মত বা দলের পৃষ্ঠপোষক নয়।এখান থেকে নিরপেক্ষতার একটি সাংবিধানিক ভ্যালূ আমরা খুঁজে পাই। এটিকে আরো পরিষ্কার এবং বিস্তৃত করার জন্য সংসদে একটি নিরপেক্ষতা এবং নির্দলীয়তা আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। রাষ্ট্রে প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য একটি নিরপেক্ষ এবং নির্দলীয় সমাজ যে অপরিহার্য এটা উপলব্ধি করা যায়। নিরপেক্ষতা লোক দেখানো না হলে তার একটি সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্যতা থাকে। কোনো একটি দলও যদি কাউকে ভেটো দেয় তাকে নিরপেক্ষ গণ্য করার প্রশ্নই আসে না। সর্বদলীয় গ্রহণযোগ্যতা নিরপেক্ষতার এসিড টেষ্ট। এই টেষ্টের মাধ্যমে দেশে নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা এখন সময়ের দাবি।

নিরপেক্ষতা মানে কোনো পক্ষে না থাকা । কেঊ তো অন্তর্যামী নয়। অন্তরে যদি পক্ষপাত থাকে তা কিভাবে যাচাই করা যাবে?এজন্য নির্দলীয়তা দলের রেকর্ডপত্র দেখে যাচাইযোগ্য হলেও নিরপেক্ষতা যাচাইযোগ্য নয়। তাছাড়া একদল কাউকে নিরপেক্ষ মানলেও আরেক দল নাও মানতে পারে। বহুদলীয় গণতন্ত্রে একজন নাগরিক কি বাস্তবে নিরপেক্ষ থাকতে পারে ? একজন ভোটারকে কি নিরপেক্ষ বলা যায়?একজন ভোটার সব সময় একই প্রতীকে বা দলে ভোট নাও দিতে পারে । ভোটার বা সমর্থক যারা এক্টিভিষ্ট নয় তারাও কি দলীয় ? গোপনে ভোট দেয়া একজন ভোটারের সাংবিধানিক অধিকার। কাজেই ভোটার কোন দলে ভোট দিয়েছে তা কোনো দল বা ব্যক্তির পক্ষে জানা সম্ভব নয়। পাগল এবং শিশু ছাড়া কেঊ নিরপেক্ষ নয় এটা কোনো যুক্তিসংগত কথা নয়। ভোটের গোপনীয়তা একজন নাগরিকের অধিকার। প্রকাশ না হলে একজন ভোটারকে নির্দলীয় গণ্য করা সমীচীন।সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষ বুদ্ধিজীবীদেরও নিরপেক্ষ মনে করে না। যদিও অনেক বুদ্ধিজীবী এখনো সত্যি সত্যি নিরপেক্ষ। তবে বুদ্ধিজীবীরাও নিরপেক্ষ থাকার চেয়ে দলভূক্ত থাকতে বেশী উৎসাহী। কারণ, নানান সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ও প্রটেকশন দলে থাকলে পাওয়া যায়। দলের বাইরে থাকলে তা পাওয়া যায়না।দলের বাইরে থাকলে তারা নিরাপত্তাহীনতাই ভুগেন।

রাজনৈতিক বিবেচনায় সকল নিয়োগ এবং পদোন্নতি বন্ধ করা সম্ভব হলে বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় স্বতস্ফূর্তভাবে নির্দলীয় হবে বলে আশা করা যায়। তাহলে সবার আগে নিয়োগ এবং পদোন্নতির জন্য সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া খুঁজে বের করতে হবে এবং এ কাজটি কেবলমাত্র স্বাধীন বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় ছাড়া অন্য কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। সুযোগ সুবিধার মোহমুক্ত দলীয় বুদ্ধিজীবীত্ব বিরল। মাথায় সব সময় দলীয় এজেন্ডা কাজ করলে সত্যিকার বুদ্ধিজীবী হওয়া যায় না। মত ও পথের ভিন্নতা থাকলেও জাতিসংঘ ঘোষিত ত্রিশটি মানবাধিকার, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং উদার ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে জাতীয় বুদ্ধিজীবী কাউন্সিল নামক একটি প্ল্যাটফর্মে বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব। এটা করতে পারলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মা শান্তি পাবে।সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবীত্বের উৎপাত ও উপদ্রবে নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীত্ব তাই একটি বিপজ্জনক নিঃসংগতা। কেঊ তার পাশে থাকে না।নিরপেক্ষ সিভিল সমাজ যখন নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীত্বের সারথী বা সহযোদ্ধা হবে কেবল তখনই এই ভয়াল নিঃসংগতার অবসান আশা করা যায়।

আমাদের সমাজটা নানান দল,মত বা ধর্মে বিভক্ত। ভিন্ন মত ও পথ থেকে দেশে চব্বিশ ঘণ্টা ঘৃণা বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা এবং অসহিষ্ণুতা উৎপাদিত হচ্ছে। যুদ্ধংদেহী, মারমুখী, বিভক্ত এবং দ্বন্দ্ব সংঘাতপূর্ণ সমাজে সিভিল সমাজ রেফারি বা কুলিং মেকানিজম হিসেবে কাজ করে। উত্তেজনা প্রশমনের জন্য এটার দরকার আছে।কমিউনিস্ট সিস্টেমে পার্টি সবকিছু।এখানে সিভিল সোসাইটির প্রয়োজন নেই। কিন্তু ওয়েষ্ট মিনিষ্টার সিস্টেমে পশ্চিমা বিশ্বের আদলে একটি সিভিল সোসাইটির দরকার আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সুখী দশটি দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার পরিস্থিতি, জীবন মান , শিক্ষার মান এবং মানব উন্নয়নসূচক আমাদের মন কাড়ে। কেননা এটা অক্সফোর্ড, কেম্ব্রিজ এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি নর্ম।আমরা এন জি ও গুলোর এক্টিভিজম এবং মানবাধিকার বোধ থেকে এ নর্মটা পেয়েছি।

সিভিল সোসাইটির অনেকে বাংলা করে সুশীল সমাজ ।সুশীল বলতে বোঝায় নিরামিষ, নিরীহ বা ভদ্র গোছের কিছু । নিরীহ বা ভদ্র যাই হোক দেশে ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং হিংসা হানাহানি দূর করার জন্য তাঁদের বিকল্প নেই। অনেকে মনে করে এদের দ্বারা সাজিয়ে গুছিয়ে কথা বলা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হবে না।সিভিল সোসাইটির বাংলা সিভিল সমাজ এক্ষেত্রে যথার্থ মনে হয় । সিভিল লিবার্টির বাংলা নাগরিক অধিকার বলায় শ্রেয় । রাষ্ট্র ধারণার আগে নাগরিক অধিকারের অস্তিত্ব ছিল। আমাদের সংবিধানে এক থেকে সাত চল্লিশ নম্বর অনুচ্ছেদ নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত এবং সংবিধানের এ অংশটুকুকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো বলাহয় ।এগুলো সংশোধন অযোগ্য।কেননা এগুলোতে নাগরিকদের মালিকানাস্বত্ব দেয়া হয়েছে যা নাগরিক ক্ষমতায়নের একটা দলিল। কিন্তু এগুলোর সব অনুচ্ছেদ আদালতে বলবৎযোগ্য নয়। এগুলোর সবগুলোকে আদালতে বলবৎযোগ্য করা এখন সময়ের দাবি। কেননা রাষ্ট্রের বয়স পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। অধিকার অর্জনের জন্য জনগণকে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে ?

দলীয় ব্যানারে পরিচিত হয়ে একজন বুদ্ধিজীবীর পক্ষে বিজ্ঞান মনস্ক কিংবা এডওয়ার্ড সাঈদ বা নোয়াম চমস্কি হওয়া অসম্ভব। দলীয়তা একজন শিল্পী এবং সাহিত্যিকের শিল্প-সাহিত্য চর্চার জন্য একটি অনতিক্রম্য মনস্তাত্বিক দাসত্ব বা বাধা।এক্ষেত্রে একজন শিল্পীর বিবেকের স্বাধীনতা,চিন্তার স্বাধীনতা এবং প্রকাশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকেনা। যা একটি মহান শিল্পের অত্যাবশ্যকীয় এবং অপরিহার্য গুণ।

মানবাধিকার , গণতন্ত্র ও সংবিধান সুরক্ষার একমাত্র গ্যারান্টি জাগ্রত ও শিক্ষিত সিভিল সমাজ। আমাদের দেশের সিভিল সমাজ নানান দলীয় পরিচয়ে দ্বিধাভিভক্ত। দ্বিধা বিভক্তির জন্য পাশ্চাত্য সমাজের মত রাজনীতির নিয়ামক বা অক্ষ শক্তির ভুমিকা সিভিল সমাজ গ্রহণ করতে অপারগ। অশুভ শক্তি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক এবং আর্থিক খাতে হানা দিবে যদি না সিভিল সমাজ তার সার্বক্ষণিক অতন্দ্র প্রহরী থাকে। সিভিল সমাজকে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় করা না হলে এই সমাজ জাতিকে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে পারবেনা। আর নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি সমাজকে দিতে না পারলে মানবাধিকার,গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সংবিধান বিপন্ন হবে। একটি নিরপেক্ষ সিভিল সমাজ ছাড়া অন্য কেউ গণতন্ত্রের খেলায় যথার্থভাবে রেফারির ভূমিকা পালন করতে পারে না । নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীত্ব সমাজে নিরপেক্ষতাকে বাঁচিয়ে রাখবে। নিরপেক্ষতার মৃত্যু হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভারসাম্য হারিয়ে যাবে।

কোনো একটি দলকে ভোট দিলেও এদেশের অধিকাংশ জনগণ নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ।আবার সুবিধার একটু হেরফের হলে ভোল পাল্টাতেও বাঙালির জুড়ি মেলা ভার। এদেশের জনগণ নিরীহ প্রকৃতির। ধর্মান্ধতা,দলান্ধতা, চরমপন্থা এবং জংগিপনা তাদের পছন্দ নয়। ভাল পরিবেশ এবং পশ্চিমা বিশ্ব বা বিশ্ব বিবেকের সমর্থন পেলে দেশের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবীও নির্দলীয় এবং নিরপেক্ষ থাকতে চায়। সর্বদলীয় আস্থা এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে ব্যর্থ হলে বুদ্ধিজীবীদের এই নির্দলীয়তা এবং নিরপেক্ষতা কোনো কাজেই আসবে না। তবে আস্থা এবং গ্রহণযোগ্যতা অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়। এর ফলে হারিয়ে যাওয়া নিরপেক্ষতার পরিবেশ ভিন্ন আংগিকে আবার ফিরে আসতে পারে। সেই সাথে ফিরে আসবে রাষ্ট্র সংস্কার বা মেরামত করার সুযোগ। রাষ্ট্রের টুকটাক মেরামতে কোনো কাজ হবে না।জাতীয়তাবাদ, উদার ধর্মনিরপেক্ষতা গণতন্ত্র,সমাজতন্ত্র, মানবাধিকার রক্ষা এবং জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য লাগবে অনেক বড় ধাচের রাষ্ট্র মেরামত ।

Share This Post