নিম্ন আদালতের কোর্টরুমের পরিবেশ এবং একজন অ্যাডভোকেটের অভিজ্ঞতা

অ্যাডভোকেট আমেনা হুদা :
ইদানিং আমরা নারী অ্যাডভোকেটগণ নারীর ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার নিয়ে আন্দোলন করি নানা ফোরামে কথা বলি। আমাদের সাথে দেশ বরেণ্য অনেক পুরুষও তাতে অংশগ্রহণ করেন। প্রশ্ন জাগে কর্মক্ষেত্রে আমরা কি আদৌ নারীর ক্ষমতায়ন, যথার্থ সম্মান ও নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে পেরেছি?
মূল কথায় আসি। অনেকেই মনে করেন একজন নারী অ্যাডভোকেট তার উপর যদি হন হিজাবী, তাহলে নিশ্চয়ই উনি হয়তো ততো যোগ্যতা সম্পন্ন কেউ না, আপনারা ভুলে গেলে চলবে না হিজাব একজন মুসলিম নারীর অলংকার স্বরূপ। এটিকে অবজ্ঞার চোখে দেখা কোনো অ্যাডভোকেট বা কোনো বিচারকের উচিত নয়। কেননা কোট অঙ্গনে যেই সকল বিচারক বিচারকের আসনে বসেন তাদের সকল সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন দেশের জনগণের ভ্যাট ও ট্যাক্সের টাকায়। ক্ষমতার চেয়ারে বসে এই কথা ভুলে যাওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
আরেকটি বিষয় হলো, বিচারকার্য পরিচালনায় যেমন একজন বিচারপতির গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে ঠিক তেমনিভাবে একজন অ্যাডভোকেটেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একজন অ্যাডভোকেট টাকার বিনিময়ে তার মক্কেলের মামলার শুনানিতে অংশগ্রহণ করেন তাই তার যৌক্তকতা দিয়ে তিনি তার শুনানিতে বলবেন এটা তার মক্কেলের অধিকার, ঠিক একইভাবে একজন বিচারক তা শ্রবণ করবেন এবং লিপিবদ্ধ করবেন এটাই তার দায়িত্ব। একজন আইনজীবী আইন বিষয়ে পড়াশোনা করে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের অধীনে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সনদ নিয়ে অ্যাডভোকেট হিসেবে কোটে আসেন, ঠিক অনুরূপভাবে একজন নিম্ন আদালতের বিচারকও বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের অধীনে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে বিচারক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বিচারক আর এ্যাডভোকেটগণের মধ্যে তফাৎ শুধু মাত্র পদ পদবী অন্য কিছু নয়। একজন এ্যাডভোকেট বিনয়ের সাথে কোর্টরুমে বিচারক বা বিচারপতিদের Your honor/MyLord বলে সম্বোধন করেন ঠিক একই ভাবে একজন অ্যাডভোকেট সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখেন।
গত ১৭ জুলাই, গাজীপুর জেলা জজকোর্ট এর অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত ০২, এ আমি মামলার শুনানি চলাকালীন উপস্থিত ছিলাম। একটা বিষয়ে আমার চোখ আটকে যায়, গাজীপুরের অনেক অ্যাডভোকেট হাইকোর্ট বিভাগের অ্যাডভোকেটগণের মতোই পোশাক পরিধান করেছেন। কৌতূহলবশত ঠিক একই রকম পোশাক পরিধান করা একজন সিনিয়র অ্যাডভোকেটের কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে জানতে চাই আপনি কি এখানকার সিনিয়র এ্যাডভোকেট? উনি বললেন হ্যাঁ, পরে জানতে চাইলাম আপনার কি হাইকোর্ট সনদ আছে! প্রতিউত্তরে তিনি রেগে গেলেন। ক্ষীপ্ত হয়ে বললেন- এই পোশাক পরিধান করা আমাদের এই কোর্টের নিয়ম। আমি বললাম, এটা কোনো আদেশে আছে? পাশ থেকে আরেকজন বললেন আদেশ থাকতে হবে কেন।
এই বিষয়ে আমি পড়াশোনা করে দেখলাম ক্রিমিনাল রুলস এন্ড অর্ডার-২০০৯ এর ৪৮৮ এবং ৪৮৯ ধারায় বলা আছে, ক্রিমিনাল মামলা শুনানিতে নিম্ন আদালতের আইনজীবীগণও একই রকম পোশাক পরিধান করবেন তবে এই বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের সিভিল রুলস এন্ড অর্ডার অধ্যায় ৩৭, বিধি ৮২৫ এ বলা আছে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবীগণ অধঃস্থন আদালতে উপস্থিত হলেও সুপ্রিম কোর্ট যে গাউন পরিধান করেন সেই গাউন পরিধান করবেন কিন্তু বিধি ৮২৬ এ বলা আছে অধঃস্থন বা নিম্ন আদালতের আইনজীবীগণ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের মতো পোশাক পরিধান করবেন না। এসব জানতে চাইলে অনেকেই আমার কাছে আমার আইডি কার্ড চাইলেন কিন্তু দুঃখের বিষয় হল ওখানে উপস্থিত কোনো অ্যাডভোকেটের গলায় তো তাদের আইডি দেখলাম না এমনকি বিচারকেরও না।
তাৎক্ষণিকভাবে আমার মনে হয়েছে আমি এই বিষয়ে বিচারকের হস্তক্ষেপ চাইতে পারি। তাই আমি বিচারকের ডায়াসের সামনে আসি এবং হাত তুলে may I proceed your honour বলি। বিচারক আমাকে বলেন hold on, আমি বললাম ok fine sir। যখন ডায়াস থেকে অ্যাডভোকেটগণ সরে যান তখন আমি ডায়াসে দাঁড়াই এবং বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। আর স্যারকে বলি স্যার আমি ঢাকা বারের অ্যাডভোকেট, হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করি। প্রতি উত্তরে উনি বললেন, হাইকোর্টের অনেক অ্যাডভোকেটের মামলা আমি শুনি তাতে কি হয়েছে, আমি বললাম স্যার আপনার কোর্টরুমে পোশাক এর নিয়ম নিয়ে কথা বলায় এখানকার অনেক আইনজীবী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ এবং অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছেন। এই বিষয়ে আমি আপনার হস্তক্ষেপ কামনা করছি। উনি বলেলেন, এই বিষয়ে আমার এখতিয়ার নাই, তখন আমি স্যারকে বললাম আপনার কোর্টরুমে একজন নারী আইনজীবীর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণে আপনি কিছু বলবেন না! তখন তিনি বলেন, এটা আমার এখতিয়ারভূক্ত নয়, আপনি সভাপতির সাথে কথা বলেন। আমি বললাম, ওকে স্যার, ধন্যবাদ। অথচ কোর্টরুমে একজন অ্যাডভোকেটের আইনগত আশ্রয় প্রদান করা তার দায়িত্বের অংশ।
যা হোক, আমি যখন কোর্ট রুমের বাহিরে আসতে চাই তখন সমিতির এক নারী সদস্য আমার হাত ধরে বলেন আপনি আমাদের সভাপতির রুমে চলেন। আমি উনাকে বললাম আপনি আমার গায়ে হাত দেবেন না, আমিও একজন অ্যাডভোকেট এবং সাবেক আইন কর্মকর্তা ও একজন সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রী, এই কথা বলার সাথে সাথে উপস্থিত কিছু অ্যাডভোকেট আমাকে এবং আমার স্বামী সম্পর্কে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করেন। পরে আমি সভাপতির রুমে আসি আমার সাথে প্রায় ৫০ জনের মতো অ্যাডভোকেট ও বার এসোসিয়েশনের কিছু মেম্বারও আসেন এবং আমাকে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলতে থাকেন। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বিষয়টি আমার হাজবেন্ডকে মুঠোফোনে জানাই। ঘটনার প্রায় ১৫ মিনিট পর সভাপতি স্যার রুমে প্রবেশ করেই আমাকে বললেন, আপনি একদম চুপ করে বসে থাকবেন কোনো কথা বলবেন না। আমি আগে ওদের কথা শুনবো।
প্রথমে তিনি উনার বারের মেম্বারদের কাছ থেকে শুনলেন। যারা আমাকে তার সামনেও ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে কথা বলেছেন। শুনার পর আমাকে বললেন আপনার আইডি দেন। আমি আইডি দিলাম উনি ঢাকা বারে কল দিলেন এবং আমার কোনো কথা না শুনে ঢাকা বারের কোনো একজন সদস্যকে ফোনে বললেন, আপনার ঢাকা বারের অ্যাডভোকেট পরিচয়ে একজন আমার এখানে তোলপাড় শুরু করেছেন উনি কি অ্যাডভোকেট কিনা দেখেন তো, ঢাকা বার থেকে তখন বলেন আমি ২০১৬ সালের এ্যাডভোকেট। তখন উনি আমার কাছে জানতে চান কি হয়েছিল কোর্টরুমে? আমি বলি যে অ্যাডভোকেট আমাকে নিয়ে গালিগালাজ করেছেন উনাকে ডাকুন কিন্তু উনি কিছুই বলেননি, উনি সমিতির সেক্রেটারিকে ডাকলেন ৩০ মিনিট পর উনি আসলেন এবং আমি উনাকে জানাই পুরো ঘটনা শুনে বললেন, দেখেন এখন তো অনেক গরম, কোর্ট গাউন পড়লে এমনিতেই অ্যাডভোকেটদের মাথা গরম থাকে, তাই কেউ এমন আচরণ করেছেন হয়তো।
ততক্ষণে আমার স্বামী সভাপতির রুমে আসলেন। তখন তিনি আমাকে বললেন, আপনি চলে যান আপনার স্বামীর সাথে আমরা বিষয়টি দেখতেছি, কিন্তু তিনি পরবর্তীতে এই বিষয়ে আর কিছুই করেননি। আমি এ ব্যাপারে ঢাকা বার ও সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের হস্তক্ষেপ কামনা করছি যাতে করে ভবিষ্যতে নিম্ন আদালতে কোনো অ্যাডভোকেট, বিশেষ করে নারী অ্যাডভোকেটরা এমন ঘটনার শিকার না হন।
তাছাড়া নিম্ন আদালতের অ্যাডভোকেটদের পোশাকের সাথে উচ্চ আদালতের অ্যাডভোকেটগণের পোশাকের মিল থাকা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যাতে করে নিম্ন আদালতের অ্যাডভোকেটগণ উচ্চ আদালতের অ্যাডভোকেটগণদের পোশাক দেখেই চিনতে পারেন এবং পোশাক নিয়ে এ ধরণের বিভ্রান্তি ও কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
লেখক: সাবেক আইন কর্মকর্তা, ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়।