টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন

টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন

মুঃ আবদুল হাকিম :

উন্নয়ন বিজ্ঞান একটি বহুমাত্রিক বিজ্ঞান। সতেরোটি টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডাই মানব সম্পদ উন্নয়নের সাথে কোনো না কোনো ভাবে সংশ্লিষ্ট। টেকসই উন্নয়নের এক নম্বর এজেন্ডা হল দেশে কোনো দারিদ্র্য থাকবে না এবং দু নম্বর এজেন্ডা হল কেউ না খেয়ে থাকবে না। তিন নম্বর এজেন্ডা হল সবার ভাল স্বাস্থ্য থাকবে। চার নম্বর এজেন্ডা হল গুণগত মানের শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ। পাঁচ নম্বর এজেন্ডা হল জেন্ডার সমতা আনয়ন। ছয় নম্বর এজেণ্ডা হল ক্লীন ওয়াটার এন্ড স্যানিটেশন যা তিন নম্বর এজেন্ডার সাথে সম্পৃক্ত। সাত নম্বর এজেণ্ডা হল পরিচ্ছন্ন এবং সস্তা জ্বালানি । আট নম্বর এজেন্ডা সম্মানজনক কাজ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। নয় নম্বর এজেন্ডা হল শিল্প, উদ্ভাবন এবং অবকাঠামো নির্মাণ। দশ নম্বর এজেন্ডা হল বৈষম্য হ্রাস । এগারো নম্বর এজেন্ডা হল টেকসই নগর এবং জনপদ নির্মাণ। বারো নম্বর এজেন্ডা হল দায়িত্বশীল ভোগ এবং উৎপাদন। তেরো নম্বর এজেণ্ডা হল ক্লাইমেট একশন । চৌদ্দ নম্বর এজেণ্ডা হল লাইফ আণ্ডারওয়াটার। পনেরো নম্বর এজেন্ডা লাইফ অন ল্যাণ্ড। ষোল নম্বর এজেন্ডা হল শান্তি, ন্যায়বিচার এবং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান । সতেরো নম্বর এজেন্ডা পার্টনারশীপ।

বর্তমান অর্থ বছরে গরীবদের এক লক্ষ সাত হাজার কোটি টাকার সামাজিক নিরাপত্তা ভাতা দেয়া হয়। আগামি অর্থ বছরে টাকার পরিমাণ নিঃসন্দেহে আরো বাড়বে। এই টাকার মাধ্যমে দান হয় কিন্তু কর্মসংস্থান হ্য় না। কৃষি এবং শিল্পে ভর্তুকি না দিলে অনেকগুলো টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। অথচ এ ভর্তুকিতে নানান দিক থেকে বাগড়া দেয়া হয়।এক সময় সরকার এবং এনজিও সমাজ দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র প্রণয়নে অনেক ব্যস্ত ছিল। বিদেশী টাকা ধার করে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্প বানানো এবং খরচ করা একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল । অথচ এ দারিদ্র্য শিল্প টিকিয়ে রাখার জন্য অঢেল টাকা খরচ করা হলেও বিগত ৭৫ বছরে বহু শিল্প কারখানা বন্ধ করে বহু লোককে কর্মহীন করা হয়েছে। দেশে ট্যাক্স, শুল্ক এবং খাজনা আদায়ে ধনীদের উপর যতটা চাপ দেয়ার কথা ছিল ততটা চাপ কখনো দেয়া হয়নি। ফলে বেশি আভ্যন্তরীণ সম্পদ সংগ্রহ সম্ভব হচ্ছে না।

বাংলাদেশ ৫০ বছর আগে স্বাধীন হয়েছে। এই ৫০ বছরে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নে সরকারের ফোকাস ছিল বেশি।অবকাঠামোগত উন্নয়ন নয় নম্বর টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডার একটি অংশ।রাষ্ট্রের সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হচ্ছে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে। বিশাল প্রকল্প ব্যয় সংস্থান করার জন্য জনগণের উপর করের বোঝা বাড়ছে। করের বোঝার দরূণ আমাদের দেশের ব্যবসায়ী এবং বিনিয়োগকারীরা বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে।এসব উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়নে প্রকৌশলী সম্প্রদায় এবং পরিকল্পনা কমিশন মূখ্য ভূমিকা পালন করে। প্রকৌশলীগণ গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কতৃক প্রণীত রেইট সিডিউলের ১০% বাড়িয়ে দিয়ে প্রকল্পের প্রাক্কলন প্রস্তুত করেন। রেইট শিডিউলগুলো ক্রস ভেরিফিকেশনের মাধ্যমে প্রণীত হয় না। এসব রেইট সিডিউলে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দেখানো হয়। আবার উচ্চমানের নির্মাণ সামগ্রীর রেইট ধরে প্রাক্কলন হলেও ঠিকাদারগণ বেশি লাভের জন্য নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার করে। ফলে খরচ বেশি হলেও কাজের মান খারাপ হয়। প্রকল্পগুলো প্রস্তুত হয় দপ্তর অধিদপ্তরে। পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় মন্ত্রণালয়ে। অনুমোদন হয় পরিকল্পনা কমিশনে। ঠিকাদার সম্প্রদায় তা বাস্তবায়ন করে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের মূলসৈনিক ঠিকাদার সম্প্রদায়।তাদের কালো তালিকা ভূক্ত করার একছত্র ক্ষমতা শুধু প্রকৌশলীদের হাতে। এ সম্প্রদায় এত প্রভাবশালী যে প্রকৌশলী সম্প্রদায় ইচ্ছেকরলেও তাদের কাছ থেকে এককভাবে ভাল কাজ আদায় করতে পারবেনা বা তাদেরকে এককভাবে কালো তালিকাভূক্ত করতে পারবে না। অন্যান্য সংস্থা এবং পেশাজীবীদের নজরদারিতে সম্পৃক্ত করা হলে সুফল আশা করা যেতে পারে। এ জাতীয় উন্নয়নে সমাজবিজ্ঞানী এবং অর্থনীতিবিদদের তেমন একটা ভূমিকা নেই।তাঁদেরও একটা ভূমিকা রাখা যেতে পারে। অতি সম্প্রতি DJFB নামে দেশে একটি উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম গঠন করা হয়েছে যা অনেক আগে গঠন করা উচিৎ ছিল। উন্নয়ন তথ্য প্রবাহ অবাধ করা হলে এক্ষেত্রেও সুফল আশা করা যায়।

দেশব্যাপী সমাজ গবেষণার উন্নয়ন ও সমন্বয়ের জন্য জন্ম লগ্ন থেকেপরিকল্পনা কমিশনে একটি সামাজিক বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদ (সোসাল সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিল) আছে যার সামাজিক নীতি পরিকল্পনায় কোনো দৃশ্যমান অবদান নেই। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের সমাজ বিজ্ঞান এবং বাণিজ্য অনুষদ্গুলোর সাথে যৌথভাবে কাজ করার আগ্রহ বা উদ্যোগ পরিষদের পক্ষ থেকে কোনোদিন ছিলনা।ফলে যথার্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাকগ্রউণ্ড পেপার পরিষদ কোনো সময় প্রস্তুত করতে পারেনি। এ কারণে প্রতিষ্ঠানটি সম্ভাবনা অনুযায়ী সাফল্য পায়নি। প্রকল্পের কাজগুলোর গুণগত মান যাচাই করার জন্য বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন বিভাগ আছে।তবে এখানে জনবল স্বল্পতা আছে। ইদানীং জেলা প্রশাসকদের প্রকল্প পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন করার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়েছে।এতে প্রকৌশলী সমাজের তীব্র আপত্তি আছে। তাদের যুক্তি হল যেহেতু জেলাপ্রশাসকগণ প্রকৌশলী নন সেহেতু প্রকৌশলীদের ভুলভ্রান্তি ধরার যোগ্যতা তাদের নেই।মিজারমেন্ট বুকের(এম বি) মাপজোখ বুঝার ক্ষমতা আম জনতারও আছে। কোনো কিছুতে অতিমাত্রায় স্পেশালাইজেশন করা হলে সিন্ডিকেশনের আশংকাকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা এখানে জনগণের ট্যাক্সের লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। টাকাটা স্বচ্ছভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা এটা প্রকৌশলী ছাড়া অন্য কারো জানার অধিকার থাকবে না তা কি করে হয়। তাহলে সমগ্র উন্নয়ন বাজেট্কি তাদের কাছে জিম্মি হয়ে যাবে না ? তাহলে প্রকল্প ব্যয়ের স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে কিভাবে ? রাজস্ব বাজেট যেভাবে অডিট হয় উন্নয়ন বাজেট সেভাবে অডিট হয় না। প্রকল্পের গুণগত মান যাচাই করার জন্য প্রকৌশলীই হতে হবে এবং অন্যকে উমান যাচাই করতে পারবেনা তা কি করে হয়।অডিটর, সাংবাদিক বা একজন শিক্ষিত নাগরিক একটা প্রকল্প ভাল করে দেখলে খুব সহজে ভালমন্দ যাচাই করতে পারে। সেটা শতভাগ নিখুঁত নাও হতে পারে। প্রয়োজনে সেটা পূনঃতদন্ত হতে পারে।

আয়তন অনুপাতে বাংলাদেশের অপ্টিমাম জনসংখ্যা দশ কোটির মধ্যে থাকা উচিৎ ছিল। অথচ আমরা বিশকোটির কাছাকাছি চলে এসেছি। অর্থাৎ পরিবার পরিকল্পনায় আমাদের ঘাটতি ছিল। ক্যারিয়ার পরিকল্পনার সাথে শিক্ষা পরিকল্পনার কোনো সামঞ্জস্য নেই। মন্ত্রণালয় অথবা পরিকল্পনা কমিশনে মানবসম্পদ উন্নয়ন নামে কোনো বিভাগ নেই। তাহলে মানব সম্পদ পরিকল্পনা কোথায় হচ্ছে তার কোনো সদুত্তর কারো জানা নেই। হয়তো মন্ত্রণালয় অথবা পরিকল্পনা কমিশনে মানব সম্পদ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নীতি নির্ধারকদের মধ্যে ভিন্নমত থাকতে পারে।দেশে শুধু যুব বেকারত্ব নয় বয়স্ক বেকারত্ব ও আছে। একই ধরণের বুদ্ধি বৃত্তিক শ্রমে নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গের সকলে একই বয়সে অবসর গ্রহণ করছেন না। কেউ করছেন ৫৯ বয়সে। আবার কেউ কেউ ৬৫ বা ৬৭ বছর পর্যন্ত কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রবীণ নাগরিকদের মেধা, প্রজ্ঞা এবং অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে অর্থনীতি উন্নত করার কোনো পরিকল্পনা এদেশে নেই।দেশের শিক্ষিত মানুষদের কর্মসংস্থান জোরদার করার জন্য কর্পোরেট অর্থনীতির বিকাশও আশানুরূপ নয়।আয়ুষ্কাল বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে চাকুরিতে প্রবেশ এবং প্রস্থান অন্যান্য দেশের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।এই ৫০ বছরে দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন না হওয়ার কারণ বেকার সমস্যা সমাধানকে অগ্রাধিকার তালিকায় না রাখা। বেকারের সংজ্ঞায়ন সুবিধা নিয়ে সমস্যাটিকে প্রথম থেকে হাল্কা করে দেখা বা লুকিয়ে রাখা।সপ্তাহে কয়েক ঘণ্টা কাজ করলে তাকে বেকার হিসেবে তালিকাভূক্ত না করা। যেখানে খালি চোখে ভয়াবহতা স্পষ্ট সেখানে পরিসংখ্যানের কলাকৌশলের আড়ালে সমস্যাটিকে ঢেকে দেয়া যাতে জনগণের চোখ এদিকে না পড়ে। ৬১ ব্যাংকে ১৫ লক্ষ কোটি টাকার ব্রড মানি আছে এটাকে কর্মসংস্থানে ব্যবহার করার একটা মাষ্টারপ্ল্যান খুব দরকার । পরিকল্পনার সাথে মানবসম্পদ, বিশ্বমানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, মানিমার্কেট এবং ক্যাপিটাল মার্কেটকে যুক্ত করা দরকার। কর্মসংস্থানে পলিসি প্রেসক্রিপশন খুব জরুরি । বাজারমুখী শিক্ষা এবং দক্ষতার অভাব, অপ্রয়োজনীয় সিলেবাস এবং কারিকুলামের বোঝা দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কর্ম এবং শিক্ষাবিমুখ করে তোলা ,ঘনঘন বানান ও ব্যাকরণ পরিবর্তন করে ছাত্রছাত্রীদের বানান বিভ্রাটের গোলক ধাঁধাঁয় ফেলে দেয়া, অপরিকল্পিতভাবে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বাড়িয়ে এক কোটি শিক্ষিত বেকার উৎপাদন করা এবং মানুষও টাকাকে যথাযথ দক্ষতার সাথে ব্যবহার করার মানসিকতা অর্জন না করা টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়ক নয়। এরা এখন পরিবার ও রাষ্ট্রের বোঝা। সন্ত্রাস ও দুর্নীতিও দেশে ভাল বিনিয়োগ না হওয়ার অন্যতম কারণ। ভাল বিনিয়োগ না হওয়ার দরুণ আশানুরূপ কর্মসংস্থান হচ্ছে না।

পরিবারগুলোর বাজেট থেকে অর্থনীতি শুরু হয়। পরিবার খাবার খাতে, চিকিৎসাখাতে এবং শিক্ষা খাতে বেশি খরচ করে। শিক্ষা খাতের খরচটাই মানব সম্পদউন্নয়নে ব্যয় হয় যা থেকে অধিকাংশ পরিবার কোনো রিটার্ণ পাচ্ছে না। যার ফলে পারিবারিক উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। পরিবারের যৎসামান্য সঞ্চয় দিয়ে মানুষ হয় সঞ্চয়পত্র কিনে, আর না হয় ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা রাখে অথবা পুঁজিবাজার থেকে শেয়ার কিনে। আমানতের অবস্থা ভংগুর, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ধীরে ধীরে কমছে এবং শেয়ারবাজারে পাম্পিং ও ডাম্পিং এর খেলা চলছে। সরকারের উন্নয়ন মডেল এমন হওয়া উচিৎ যাতে দরিদ্র, নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো লাভবান হয়। ধনীরা এমনি এমনি ধনী হয়। তাদের দিকে না তাকালেও চলবে। সহজ ব্যবসার সূচকে ১৬৮ নম্বরে থাকলেও দ্রুত ধনী হওয়ার তালিকায় আমরা সবার উপরে। এমতাবস্থায় ক্রমবর্ধমান আয় বৈষম্য এবং শিক্ষিত বেকারত্বকে হাল্কা করে দেখার আর অবকাশ নেই।

Share This Post