ঘুরে দাঁড়াতে হলে শ্রীলঙ্কাকাকে বেশ বড় ধরনের সংগ্রাম করতে হবে

ঘুরে দাঁড়াতে হলে শ্রীলঙ্কাকাকে বেশ বড় ধরনের সংগ্রাম করতে হবে

এহছান খান পাঠান :
আর্থিক ঘাটতি ছাড়াও বাণিজ্যিক ঘাটতি বারবার দংশন করছে শ্রীলঙ্কাকাকে। একদিকে বাণিজ্যিক ঘাটতি। অন্যদিকে আর্থিক ঘাটতি। এর মধ্যে গত ২ বছর ধরে চলতে থাকা করোনা পরিস্থিতি বিষয়টিকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে। শেষ পর্যন্ত কী ভাবে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পায় শ্রীলঙ্কা, সেদিকেই নজর রয়েছে আন্তর্জাতিক ওয়াকিবহাল মহলের। গত বছর শ্রীলঙ্কার মুদ্রার দাম আন্তর্জাতিক বাজারে দ্রুত পড়ে যেতে থাকে। একদিকে মুদ্রাস্ফীতি। অন্যদিকে চীনের কাছে বিপুল ঋণের বোঝা। চীনই শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় দ্বিপাক্ষিক অংশীদার। তাদের কাছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ রয়েছে শ্রীলঙ্কার। এখানেই শেষ নয়, দেশের আর্থিক বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতে আরও ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ধার করতে হয়েছে পরে।এদিকে রেকর্ড ছুঁয়ে ফেলেছে শ্রীলঙ্কার মুদ্রাস্ফীতি। এর প্রভাব সরাসরি গিয়ে পড়েছে দৈনন্দিন রুটিরুজির হিসেবেও। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলায় সাধারণ মানুষের কার্যত নাভিশ্বাস ওঠে গেছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি-অক্টোবরের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে ৪.৮ বিলিয়ন বিদেশী ঋণ শোধ করতে হবে। আগামী ১২ মাসের মধ্যে দেশ ও বিদেশ মিলিয়ে ৭.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এরমধ্যে ২০২২ সালের জানুয়ারির মধ্যে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সভারেন বন্ড রয়েছে। যদিও সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে রাজাপক্ষে সরকার দেশের নেতা মন্ত্রীদের সমস্ত বিদেশ সফরের খরচে কাটছাঁট আনার পথে হেঁটেছে। দেশটির সরকার অর্থ জোগাড়ের জন্য ২০০৭ সাল থেকে সার্বভৌম বন্ড ইস্যু করেছে। একটি দেশের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে এ ধরণের সার্বভৈৗম বন্ড বিক্রি করা হয়। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে এ ধরণের বন্ড বিক্রি করে অর্থের জোগান দেয়া হয়। শ্রীলংকা সেটাই করেছে। কিন্তু এই অর্থ কিভাবে পরিশোধ করা হবে সে ব্যাপারে খুব একটা চিন্তা-ভাবনা করেনি। বর্তমানে শুধু ওই বন্ড বাবদ শ্রীলংকার ঋণ রয়েছে এখন সাড়ে বারো বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া দেশীয় উৎস থেকেও সরকার ঋণ করেছে। এদিকে, ইরানের সঙ্গে তেল আমদানি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে ঋণের অঙ্ক চা রপ্তানি করে মেটানোর পথে কূটনৈতিক রাস্তা দেখেছে শ্রীলঙ্কা।

সাগরপাড়ের চমৎকার এই দেশটি এখন মারাত্মক এক অর্থনৈতিক সংকটে দাঁড়িয়ে। এই সংকট একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে একাধিক সিদ্ধান্ত বা ভুল পরিকল্পনা। গত ১৫ বছর ধরে শ্রীলংকায় সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ তেমন একটি হয়নি। একযুগের বেশি সময় ধরে শ্রীলংকায় সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, রাস্তা এবং আরও নানা ধরণের অপ্রয়োজনীয় ও অতিবাহুল্য কিছু মেগা প্রকল্পে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে দেদারছে ঋণ নিয়েছে শ্রীলংকার বিভিন্ন সরকার। যার কারণে তাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধীরে ধীরে খালি হতে থাকে। এছাড়াও কর কমানো, পর্যটন-রেমিট্যান্স থেকে আয় কমা এবং কৃষিতে অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নেয়ায় সবমিলিয়ে মারাত্মক পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়েছে একসময়ের স্বাবলম্বী এই দেশটি। মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ বেকারত্ব এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় প্রায় সব জিনিসের ঘাটতি দেখা দেয়ায় অনেক শ্রীলংকান বিদেশে উন্নত জীবনের আশায় নিজ দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। অথচ জনসম্পদ ও আভ্যন্তরীণ সমৃদ্ধিতে বেশ সক্ষম ছিল দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলংকা । প্রাচীনকাল থেকেই দেশটি ব্যবসা-বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ এখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করতো। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে কখনো এতোটা দুরাবস্থায় পড়েনি দেশটি। চরম অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এতটাই নিচে নেমেছে যে আমদানি করা কাগজের অভাবে স্কুল পরীক্ষা বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। অগণিত শ্রীলংকান এখন মূল পেশার বাইরে অন্যকিছু করতে বাধ্য হচ্ছেন। নয়তো মানবেতর জীবনযাপন করছেন বলে বিশ্ব মিডিয়ায় সেদেশের মানুষের দুর্ভোগ এর কথা উঠে আসছে। এ খাদ থেকে দেশটির বেরিয়ে আসা খুবই কঠিন হবে। এর জন্য কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। শ্রীলঙ্কায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। শ্রীলংকা যখন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো ২৫০ মিলিয়ন ডলারের কারেন্সি সহযোগিতা দিয়েছিল। এটি ছিল কোনো দেশের জন্য দেওয়া বাংলাদেশের প্রথম ঋণ। ভারত দেশটিকে খাবার ও ওষুধ কিনতে ১০০ কোটি ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছে। তারও আগে ভারত দেশটিকে ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে

কাগজ আমদানির অর্থ না থাকায় দেশটিতে পরীক্ষা পর্যন্ত বন্ধ আছে। রয়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের সংকট। চালের কেজি ৫০০ টাকা বলেও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৩ শতাংশ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেই হার ১৭ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছেছে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো সরকারের বিশদ পরিসরে অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদে কৃষি উৎপাদন ভয়াবহভাবে কমে গেছে। খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ২৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। মানুষ সকাল থেকে ছুটছে শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা মেটাতে। এছাড়াও রয়েছে ওষুধসহ অন্যান্য পণ্যের সংকট। সেখানে জ্বালানী সংকট তীব্র হয়ে পড়েছে। দেশটির পেট্রল পাম্পগুলোতে সেনা মোতায়েনের জন্য সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তেল কিনতে হচ্ছে নাগরিকদের। অন্যদিকে আমদানি করার মতো পর্যাপ্ত অর্থও নেই। ইরানের কাছ থেকে জ্বালানী তেল আমদানি বাবদ আড়াইশ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে পারেনি দেশটি। এর বিনিময়ে প্রতিমাসে পাঁচ মিলিয়ন ডলারের চা ইরানে রপ্তানি করবে শ্রীলঙ্কা। তাছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে পর্যটন কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকায় শ্রীলঙ্কায় অর্থের যোগানের একটি বড় উৎস বন্ধ ছিল। গৃহযুদ্ধের সময় অত্যাধিক সামরিকখাতে ব্যয় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে চাপে ফেলে ছিল। দেশটির জিডিপির ১০ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। গত বছর এই আয় ৬২ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালে একটি চার্চে বোমা হামলা এবং করোনাভাইরাসের কারণে এই খাতে ধস নামে। তাছাড়া সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমে গেছে। সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে ৫৪৮ মিলিয়ন ডলার এফডিআই কমেছে। ২০১৯ সালে এফডিআই ছিল ৭৯৩ মিলিয়ন এবং ২০১৮ সালে ছিল ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।করোনা পরিস্থিতির কারণে পর্যটন শিল্প প্রায় স্থবির হয়ে যায়।সব মিলিয়ে দেখা যায় করোনার ধাক্কা, ঋণ এবং কার্যকর পরিকল্পনার অভাবে দেশটি আজকে ভুগছে। এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে দেশটিকে বেশ বড় ধরনের সংগ্রাম করতে হবে।

(এহছান খান পাঠান :, নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক অর্থনীিতির কাগজ)

Share This Post